
“সারাহ! তোমাকে এতো আতঙ্কিত দেখাচ্ছে কেন”
“বন্ধুরা স্কুলে বলাবলি করছিল, যেকোনো দিন বাংলাদেশে বিশাল ভূমিকম্প হবে। ঢাকায় এতো এতো ঘিঞ্জি বাড়ি। ভূমিকম্প হলে কী করবো, কোথায় যাবো? বাসা থেকে বের হলেও তো আরেকটা বিল্ডিং মাথার উপর ভেঙে পড়তে পারে…!”
“এতো ভয় পেয়ো না! দুশ্চিন্তা শয়তান তৈরি করে, আর আল্লাহ সুবহানাহু তা’আলা সমস্ত বিপদ থেকে আমাদের রক্ষা করতে সক্ষম।”
“ভূমিকম্প কেন হয় বলো তো? এটা কী আগে থেকে বুঝা সম্ভব যে কবে ভূমিকম্প হবে?”
“ভূমিকম্প হবে এটা আগে থেকে নিশ্চিত বলা যায় না৷ আর কেন হয় সেটা এক কথায় উত্তর দেয়া সম্ভব না!”
“বিস্তারিতই শুনি না হয়।”
“আমাদের জীবনের প্রাকৃতিক দূর্যোগগুলো পরীক্ষা হতে পারে, শাস্তিও হতে পারে। আল্লাহ ভালো জানেন। আল্লাহ সুবহানাহু তা’আলা বলেন,
আমি তোমাদের পরীক্ষা করব ভয়, ক্ষুধা এবং সম্পদের ক্ষতি দ্বারা। – ২:১৫৫
আমি অনেক জাতিকে তাদের পাপের কারণে ধ্বংস করেছি। সুরা আল-হাজ্জ: ৪৫
“কেমন পরীক্ষা?”
“ধরো, আমরা যদি আল্লাহর সাহায্যের বিষয়ে নিরাশ হয়ে যাই বিপদে পড়ে তাহলে এটা পরীক্ষায় ফেল করা হলো। কেউ কেউ বিপদে পড়লে কৃপণ হয়ে যায়…!”
“আর পাপের কারণে ধ্বংস করা হয়েছে কাদের? কীভাবেই বা?”
“যেমন নুহ (আ.) এর জাতিকে অতিবৃষ্টি বা বন্যা দিয়ে, লুত (আ.) এর জাতির শহরকে উলটে দিয়ে কাঁদা মাটির শিলা ছুড়ে ধ্বংস করা হয়। আদ (আ.) এর জাতিকে ঘুর্ণিঝড় দিয়ে ধ্বংস করা হয়। সামুদ জাতিকে ভূমিকম্প ও বিকট আওয়াজে ধ্বংস করা হয়।”
“আমাদেরও যদি আমাদের সবার পাপের কারণে আযাব দেয়া হয়, বাড়ি ধ্বসে মৃত্যু হতে পারে। সবসময় কী হিজাব পড়ে থাকা উচিত না? কখন কীভাবে আমার মৃতদেহ বের করা হবে বা আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হবে!”
“না সারাহ! এটা আল্লাহর প্রতি সুধারণার বিপরীত হবে। তোমার লজ্জাশীলতা দেখে ভালো লাগলো। বারাকাল্লাহু ফীক। কিন্তু আমরা নিজেদের উপর জুলুম করবো না আর আশা করবো দীর্ঘ নেক হায়াতের ও সম্মানজনক মৃত্যুর।
এখন বলি ভূমিকম্পর বিজ্ঞান। এর জন্য পৃথিবী সম্পর্কে জানতে হবে। আমরা যে মাটির উপর হাটি এটাকে বলে ভূত্বক৷ মানে পৃথিবীর চামড়া বলতে পারো। ভূ মানে পৃথিবী আর ত্বক মানে চামড়া। আমাদের মতো পৃথিবীরও চামড়ার নিচে আরও কিছু স্তর আছে৷”
“ভূত্বকের কথা বইতে পড়েছি। ভূত্বক বা Crust, এরপরের স্তর ম্যান্টল (Mantle), আরও ভেতরে থাকে Core বা মজ্জা।”

“ঠিক সারাহ! ভূত্বকেরও দুটো স্তর আছে। সেই বিস্তারিত না বলি। ভূতক শক্ত, পাথুরে। আর এর পর যে ম্যান্টল এটা কিন্তু বেশ গরম, এতোই গরম যে এর অনেকটা নরম তরলের মতো তৈরি করে যাকে ম্যাগমা (Magma) বলে। ম্যাগমাই কিন্তু আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের সময় ফেটে বের হয়! যাকে আমরা লাভা বলি”
“কী ভয়ংকর!”
“ভয়ংকর, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মাত্রই ভয়ংকর। আল্লাহ যেন আমাদের হেফাজত করেন।”
“আমীন!”
“এরপর আসি Core এর বর্ণণায়। এর বহি:স্তরে (outer core) বেশিরভাগ থাকে তরল নিকেল আর লোহা। আর অন্ত:স্তরে প্রচন্ড গরম প্রায় ৪৫০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কঠিন পদার্থ থাকে। পানি ফুটে ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে, তাহলে চিন্তা করো এর ৪৫ গুণ বেশি তাপ! এতো তাপে তরলই থাকার কথা। কিন্তু বাইরের সব স্তরের চাপে ঘনীভুত হয়ে কঠিনই থাকে inner core”
“ভূমিকম্পটা কোথায় হয়, crust, core নাকি mantle এ?”
“এর জন্য তোমার আগে Continental drift বা ভূ-ভাগ তত্ত্ব সম্পর্কে জানতে হবে।”
“ভূ-ভাগ, মানে ভূমি ভাগ হয়ে যাচ্ছে?”
“ঠিক! অনেক অনেক আগে কিন্তু সমস্ত ভূমি এক হয়ে ছিল। আস্তে আস্তে ভাগ হয়ে মহাদেশগুলো তৈরি হলো। ভূত্বক আসলে পাজলের টুকরোর মতো কিছু অংশ। এই টুকরোগুলোকে বলা হয় টেকটোনিক প্লেট (Tectonic Plate)। এই প্লেটগুলো কিন্তু স্থির না, ভাসমান থাকে। এগুলো প্রান্ত যখন একটার সাথে আরেকটা লেগে গিয়ে পরস্পর অতিক্রম করতে যায় বা একই প্লেটের ভেতরে যখন এমন ত্রুটি (Fault) থাকে যা ভেঙে যেতে পারে, তখন প্রচন্ড শক্তির উদগীরণ হয়, আর ভূমি কেপে উঠে। মাটির নিচে সংঘাতের স্থানকে বলে ভূমিকম্পের কেন্দ্র বা Focus আর তার ঠিক উপরে ভূপৃষ্ঠ বরাবর বিন্দুকে বলে ভূমিকম্পের উপকেন্দ্র বা epicenter. কেন্দ্রে ভূমিকম্প বেশি অনুভূত হয় আর যত দূরে যাওয়া যায় কম অনুভূত হয়। যেমন একটা পুকুরে ঢিল ছুড়লে যেমন তরঙ্গের বিস্তার বা Amplitude কেন্দ্রে বেশি থাকে”

“একবার ভূমিকম্প হলে নাকি বারবার হয়? যদি কবে ভূমিকম্প হবে বুঝাই না যায় তো কীভাবে ঢাকায় ভূমিকম্প হবে এই আশঙ্কা করছে সবাই?”
“এর কারণ হলো মূল ভূমিকম্প হওয়ার আগে বা পরে ছোট ছোট ভূমিকম্প হয়৷ মূলটাকে বলা হয় Main Shock. তার আগে হয় foreshock আর পরে হয় aftershock. এই Aftershock কখনো কয়েক মিনিট পর, কখনো কয়েক দিন, মাস বা বছর পরও হয়!”
“ভূমিকম্পের মাত্রা কীভাবে বোঝা যায়?”
“ভূমিকম্প নিয়ে যারা গবেষণা করে তাদের বলা হয় সিসমোলজিস্ট (Seismologist)৷ সিসমোগ্রাফ (seismograph) দিয়ে ভূমিকম্পের কেন্দ্র, মাত্রা ইত্যাদির ধারণা পাওয়া যায়। এটায় ভূমির সাথে লাগানো একটা ভিত্তি থাকে। যার উপর একটা ভার মানে weight ঝুলছে। যখন ভূমিকম্পটা হয় তখন এর ভিত্তিটা দুলতে থাকে। কিন্তু ভার নড়ে না, বরং এটি যে সুতা দিতে ঝুলানো থাকে তা কম্পনটা শোষণ করে নেয়। ভিত্তি নড়ায় আর ভার না নড়ায় একটা গ্রাফ তৈরি হয়ে যায়, ভিত্তির উপর। আর সে তরঙ্গ থেকে সর্বোচ্চ বিস্তারটা নিয়ে লগারিদমিক (Logarithmic) হিসাব করে ভূমিকম্পের মাত্রা নির্ণয় করা হয়। লগারদমিক এই হিসাবটার ভিত্তিই হলো রিকটার স্কেল (Richter Scale)। বর্তমানে আরও সূক্ষ পদ্ধতিতে হিসাব করা হয়”

“কত মাত্রার ভূমিকম্প হলে সেটা সাংঘাতিক?”
“৬ মাত্রা থেকে ক্ষয়ক্ষতি শুরু হয়। ৯ হলে অনেক বেশি ভয়ংকর। ১৯৬০ সালে চিলিতে ৯.৫ মাত্রার ভূমিকম্প হয় এবং এটাই সর্বোচ্চ এখন পর্যন্ত।”
“কেমন ক্ষতি হয়েছিল?”
“সম্পদ তো ধ্বংস হয়েছেই, বাড়ি-ঘর ছাড়া হয়েছিল ২০ লাখ মানুষ! এরপর সুনামি (Tsunami) হয়।”
“আল্লাহু আকবার! সুনামি আর জ্বলোচ্ছাস কী একই?”
“সুনামি এক প্রকার জ্বলোচ্ছাস বলতে পারো। কিন্তু সুনামি হয় টেকটোনিক প্লেট সরে গেলে। অর্থাৎ, ভূমিকম্পর পর।”
“ভূমিকম্পের বিজ্ঞান তো জানা হলো। কিন্তু ক্ষয়ক্ষতি থেকে বাঁচার কোনো উপায় জানো?”
“কাঁচের জানালা বা ঝুলন্ত জিনিসপত্র যা ভেঙে পড়তে পারে, থেকে দূরে থাকতে হবে। টেবিল জাতীয় বা ভারি আসবাবের নিচে শুয়ে পড়ে নিজের মাথা ঘাড় হাত দিয়ে ঢেকে রাখতে হয়৷ এই সিস্টেমটাকে বলে Drop, Cover & Hold on. আর খোলা জায়গায় যেতে পারলে তো খুবই ভালো, অনেকে তাড়াহুড়া করে নামতে গিয়ে আহত হয়। আর উপকূল নিকটবর্তী এলাকায় থাকলে দূরে সরে যেতে হবে, যেহেতু সুনামি হতে পারে। মূল কথা, আমরা দুআ করবো যেন প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বাঁচা যায়, না হোক! আর হলেও ক্ষয়ক্ষতি না হোক।”

“সেটাই! দুআ মুমিনের অস্ত্র! আল্লাহ হেফাজত করুক।”
“আমীন!”